বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে বেশি বন্যা হয়?
বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে বেশি বন্যা হয় এই বিষয়টি জানার জন্য আগে আমাদেরকে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে হবে। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এবং আমাদের এই দেশটিতে রয়েছে খরচ্ছতা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্ররের মতো নদী সমূহ।
এই নদীগুলো আমাদের দেশটিকে জলের মতো ঘিরে রেখেছে । বাংলাদেশ হিমালয়ের পদতলে অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলে বন্যা ও বিভিন্ন দুর্যোগ বেশি হয়েথাকে। তাই বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে বেশি বন্যা হয় এবং কেন হয় তা জানার চেষ্টা করব।
- জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এই জেলাগুলি ব্রহ্মপুত্র, যমুনার মত প্রধান নদী গুলোর পার্শ্ববর্তী হওয়ােই, বর্ষা মৌসুমে এই জেলাগুলিতে অনেক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা যায়।
- অপরদিকে খুলনা বরিশাল সাতক্ষীরার মধ্যস্ত জেলাগুলি সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি লক্ষ্য করা যায়
- হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ মত জেলাগুলিতে হাওর, জলভূমি ও অগভীর হ্রদ থাকার কারণে। ভারী বৃষ্টিপাত হলেই এই অঞ্চর গুলিতে বার বার আকর্ষিক বন্যা হয়।
- বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার নোয়াখালী ভোলা সামুদ্রিক বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণ এলাকা। এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চল গুলোতে বছরের একটি সময়ে বন্যা হয়ে থাকে।
- বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল বান্দরবান, খাগড়াছড়ি সাধারণত পাহাড়ি বন্যা হয়, পাহাড়ি বন্যার ফলে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধস এর মত বিপর্যয় গুলো হয়ে থাকে।
- বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলাগুলোতে আমরা আকস্মিক বন্যা লক্ষ্য করে থাকি।
বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে বেশি বন্যা হয় তা সম্পর্কে একাটা ধারোনা আমরা পেয়েছি। এই জেলাগুলি ছাড়াও বাংলাদেশের আরো বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করে এই জেলাগুলিতে আমরা প্রতি বছরই বন্যা দেখে থাকি। বর্ষাকালে এই বন্যাগুলির কারণে বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে। হাজার হাজার মানুষ তাদের বাসস্থান হারিয়ে থাকে।
বন্যা কি?
বন্যা হল স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর তীর অতিক্রম করে আশেপাশের সমতল ও আবাসভূমিকে প্লাবিত করে এবং সাধারণ জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়। বাংলাদেশের নদী গুলো পাহাড়ি বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফ গলা বানিয়ে এনে প্রায় প্রতিবছরই বন্যা ঘাটায় বাংলাদেশ বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস। বন্যা মৌসুম কখনো কখনো আগাম বা দেরিতেও আমরা বন্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি।
আরো পড়ুন: সেরা ফ্রিল্যান্সিং কাজ কোন গুলি?
বাংলাদেশের বন্যা কয় ধরনের?
বাংলাদেশের সংঘটিত বন্যা প্রধানত তিন ধরনের
1 মৌসুমী বন্যা
এই বন্যা ঋতুগত এতে নদ নদীর পানি ধীরে ধীরে ওঠানামা করে। এবং বিস্তূর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জান মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
2 আকস্মিক বন্যা
এই বন্যা আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ের সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে হয়ে থাকে। এতে ফসলহানি মৎস্য সম্পদের ক্ষতি ও ভূমিধস হয়।
3 জোয়ার সৃষ্ট বন্যা
সংক্ষিপ্ত সময়ে এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত তিন থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এই বন্যা উপকূলীয় এলাকায় জলবদ্ধতার সৃষ্টি করে জা ফসল ও মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করে।
বন্যার কারণ ও ফলাফল
উজান থেকে নেমে আসা ঢাল এবং অতি বৃষ্টির কারণে প্রতি বছরই এদেশে বন্যা হয় তবে বেশ কয়েকটি কারণে এর তীব্রতা বাড়ে। বাংলাদেশের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র পাঁচ মিটার উপরে পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টির কারণে পানি দ্রুত শর্তে না পারলে বন্যার তীব্রতা বাড়ে। বৃষ্টির পানি সমুদ্রে নেমে যাওয়ার জন্য যে পত্র আছে সেগুলোতে নানা কারণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে নিচে জমিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানির আঁধার গুলো নষ্ট হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলিমাটির কারনে ভরাট হয়ে নদী উপনদী খাল ও অন্যান্য চ্যানেলগুলি নাব্যতা হারিয়েছে ফলে সহজেই পানি হচ্ছে বন্যর আকার ধারণ করছে। এছাড়াও হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহ স্থানান্তরের কারণে নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে।
বন্যায় আর্থিক ক্ষতি
বন্যা যে কেবল মানুষের জীবনকেই বিপর্যস্ত করে তা না এর ফলে দেশ ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বন্যায় রাস্তাঘাট মৎস্য ও ক্ষেত খামার ডুবে যায়। নদী প্রধান অঞ্চলগুলোতে বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, ফলে অনেক মানুষ গৃহ ও ভূমিহীন হয়ে পড়ে, বন্যার ফলে প্রতিবছর নানা রকম ফসল নষ্ট হয় ফলে খাদ্য নিরাপত্তাই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়াও খাবার পানি ও পানি নিষ্কাশন এর সুস্থ ব্যবস্থাপনার অভাবে নানা ব্যাধি রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা দেয়।
বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস
বন্যার সাথে এদেশের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মৌসুমী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মহাভারত রামায়ণ ও অন্যান্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। ৩২১ থেকে ২৯৬ খ্রিস্টপূর্বে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে তার অর্থমন্ত্রী কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের বিভিন্নস্থানে বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান উল্লেখ রয়েছে যাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে বৃষ্টিপাতের হিসাব সম্পর্কে তাদের একটা ধারণা ছিল। ৫০৭ থেকে ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বে জ্যোতিষবিদ বড়ামিহির বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে পারতেন।
জ্যোতিষবিদ আর্য ভট্ট আর ব্রহ্মপুত্র বর্ষা মৌসুম নিয়ে গবেষণা করেছেন, বিখ্যাত সংস্কৃত কবি কালিদাস রচিত মহাকাব্যে বন্যার উল্লেখ আছে। আজও বাংলাদেশ কৃষক কল প্রাচীনকালের বিধোসি নারী খনার বন্যা সম্পর্কে রচনা সমূহ স্মরণ করে। যামন পূর্বাশাড়ে দক্ষিণাবয় সেই বছর বন্যা হয়, জ্যৈষ্ঠতে তারা ফোটে তবে জানবে বর্ষা বটে,
বাংলাদেশের ভয়াবহতম বন্যা
স্বাধীনতা পরবর্তী ভয়াবহতম বন্যার মধ্যে ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪,২০০৭, ২০১৭ ও ২০২০ ছেলের বন্য উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৪ সালে ময়মনসিংহে প্রায় ১০৩৬০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বন্যা কবলিত হয় মানুষ ও গবাদি সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও লক্ষ লক্ষ বাড়ি বিধ্বস্ত হয়।
১৯৪৭ সালের বন্যা ছিল দীর্ঘস্থায়ী জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী এই বন্য, ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা গ্রাস করেছিল যা ছিল দেশের মোট আয়তনের ৪০ শতাংশ।
তবে ১৯৮৮ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয় এবং এই বন্যায় ৮২ হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাই আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী এ্ই বন্যায় রাজধানী ঢাকা কেউ গ্রাস করে।
অন্যদিকে ১৯৯৪ সালের বন্যায় সবচেয়ে বেশি এলাকা প্লাবিত হয় এ সময় দেশের ৭৫% তলিয়ে যায় এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় প্রায় তিন কোটি লোক এই বন্যায় ঘরবাড়ি হারায় এবং এক হাজারেরও বেশি লোক মারা যায় সাত লক্ষ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায় এরপর ২০০৪ সালের বন্যাও ছিল ১৯৮৮ সালের মতো ভয়াবহ দেশের প্রায়ই দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়।
২০০৭ সালের বন্যাকে বলা হয় মহা বন্যা এতে দেশের প্রায় 4 শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয় এবং ২০২০ সালের বন্যায় ৪ দফায় মোট ৩৩ জেলা কবলিত হয় প্রতিবছর ঘটে যাওয়া এসব বন্যা থেকে রক্ষা পেতে বন্যপ্রাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র হতে স্বল্পমেয়াদী পাঁচ দিন এবং মধ্যমেয়াদী হিসেবে দশ দিন পূর্বে পূর্বাভাস দেয়া হয় বন্যার ক্ষতি অনেকাংশে কমে আসে।
বন্যা প্রতিরোধের উপায়
বাংলাদেশের প্রায় তিন চতুর্থাংশ এলাকা ভারতের সাথে মিশে থাকার কারণে বাংলাদেশের অনেক নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে। আর ভারত এই নদীগুলোর গতিপথে বাঁধ সৃষ্টি করে নদী প্রবাহকে বিঘ্ন ঘটায় তাই বর্ষাকালে একটি সময়ে যখন ওই বাঁধ গুলি থেকে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পায় তখন বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল প্লাবিত হয়। আর এমন বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করেছে বন্যায় মানুষের প্রাণহানি কমিয়ানা সম্ভব না হলেও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই ক্ষয়ক্ষতির রাস করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, বন্য সহনশীল সরষের জাত উন্নয়ন, বাঁধ নির্মাণ, হাইড্রোলিক অবকাঠামো যেমন রাবার ডাম, ব্যারেজ, জলাধার ইত্যাদি নির্মাণ, বন্যা সহনশীল ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল নির্মাণ, আশ্রয় কেন্দ্র ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ গ্রামীণ মাটির রাস্তার পরিবর্তে পাকা রাস্তা নির্মাণ এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা বন্যাকে আটকাতে না পারলেও এর থেকে হওয়া ক্ষতি থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাব।
বাংলাদেশের নদী গুলোর মাধ্যমে বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকলেও এদেশের নদীগুলো শরীরের রক্ত ধরার মতোই যেন এ দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে ।তাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে এদেশের নদীগুলোকে আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আরো অনেক দিন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সঠিক মৌসুমে নদীগুলোকে খনন করতে হবে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ থেকে আমাদেরকে পিছন হাটতে হবে।
শেষ কথা
আশা করি বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বন্যা বেশি হয়। বাংলাদেশে বন্যা কয় ধরনের, বন্যা কি বন্যার কারণ ও ফলাফল বন্যার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে বন্যার পূর্বের ইতিহাস বাংলাদেশের ভয়াবহতম বন্যা বন্যা প্রতিরোধে আমাদের করণীয় এ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।